বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩১ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষিকা নাসরিন আক্তার (ছদ্মনাম) স্বামী বিদেশে থাকার সুযোগে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রহমত আলী তার সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি করেন। পরে ওই সম্পর্ক প্রেম-ভালবাসায় রূপ নেয় এবং চেয়ারম্যান ফুসলিয়ে ও বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে ওই শিক্ষিকার প্রবাসী স্বামীকে তালাক দিতে বাধ্য করেন। তালাক পরবর্তী চেয়ারম্যান নিজের সাজানো এক কাজী অফিসে গিয়ে উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ ঘটনার কিছু দিন পর ওই চেয়ারম্যান শিক্ষিকাকে না জানিয়ে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করেন। এর প্রতিবাদ করলে চেয়ারম্যান ওই শিক্ষিকাকে স্ত্রী হিসেবে অস্বীকার করেন এবং জানান, ভুয়া কাবিননামা তৈরি করে তিনি তাকে বিয়ে করেছিলেন।
অসহায় শিক্ষিকা বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন। এখানে আমাদের আলোচনা বিষয় হচ্ছে যে, আমাদের বিদ্যমান আইন অনুসারে ‘ধর্ষণ’ সংঘটিত হয়েছে কি-না। এই ঘটনাগুলোর সূচনা হয়েছে প্রেম-ভালবাসার মাধ্যমে; যেখানে সম্পর্কের একটা পর্যায়ে গিয়ে প্রেমিক পুরুষটি সঙ্গী নারীটিকে বিয়ের প্রলোভন বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য করছে। পরে পুরুষটি যখন তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, ঠিক তখনই নারীটির তরফ থেকে আদালতে গিয়ে ‘ধর্ষণের’ মামলা ঠুকে দিচ্ছে।
এখন আমাদের দেখার বিষয় হচ্ছে এই যে, প্রচলিত আইনে এ ধরনের সম্পর্ককে ধর্ষণ বলা যায় কি-না। আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষনের ব্যাখায় বলা হয়েছে যে, কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষন করেছেন বলে গন্য হবেন।
ধর্ষণের সংজ্ঞা থেকে আমরা যা পাই তা হলো (১) ভিকটিমের বয়স ১৬ বছরের নিচে হতে হবে (২) তার যৌনকর্মে সম্মতি থাকলেও ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে (৩) যিনি ওই ভিকটিমের সঙ্গে যৌনকর্ম করেছেন তিনি ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন। এবং এজন্য তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন। তবে যদি ১৬ বছরের অধিক হয় তা হলে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি থাকলে তাকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা যাবে না এবং যৌনকর্মের সঙ্গীকেও দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়া যাবে না।
আমাদের দ-বিধি আইনের ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, যদি কোন পুরুষ নিম্নোক্ত পাঁচটি অবস্থার যে কোনটিতে কোন নারীর সাথে যৌন সঙ্গম করে তাহলে সে ধর্ষণ সংঘটন করেছে বলে গণ্য হবেঃ- ১) নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে; ২) নারীর সম্মতি ছাড়া; ৩) মৃত্যু বা জখমের ভয় দেখিয়ে সম্মতি নিয়ে; ৪) নারীর সম্মতি নিয়েই, কিন্তু পুরুষটি জানে যে সে ঐ নারীর স্বামী নয় এবং পুরুষটি তাও জানে, নারীটি তাকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে যে পুরুষটির সঙ্গে তার আইনসঙ্গতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে সে বিশ্বাস করে; ৫) নারীর সম্মতিসহ কিংবা সম্মতি ছাড়া যদি সে নারীর বয়স ১৪ বছরের কম হয়। ব্যতিক্রমঃ-১৩ বছরের কম নয় এমন স্ত্রীর সাথে স্বামী যৌন সঙ্গম করলে ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না। এখানে কোথাও বলা হয়নি একাধিক বিয়ে হয়েছে বা কুমারীত্ব নেই এমন নারী ধর্ষণ সংজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবেন। এমনকি এই আইন পতিতাদের জন্যও প্রযোজ্য যদি সে তা প্রমাণ করতে পারে।
উপরের চার নম্বর পয়েন্টটি দ-বিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী ‘ধর্ষণ’ হিসেবে গণ্য হতে পারে। কেননা, ওই ঘটনায় অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান ভুয়া কাবিননামা তৈরি করে নারীটির মধ্যে এই বিশ্বাস তৈরি করেছিলেন যে, তারা আইনানুগভাবে বিবাহিত। কিন্তু চেয়ারম্যানের ইচ্ছে ছিল না, তাকে বিয়ে করার। সুতরাং ৩৭৫ ধারায় উল্লিখিত চতুর্থ অবস্থার সঙ্গে এই ঘটনাটি মিলে যায় এবং খবরে উল্লিখিত সংবাদ সত্য হলে নিঃসন্দেহে এটি ‘ধর্ষণ’।
কিন্তু প্রথম তিনটি দৃশ্যপটে যে ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে কি-না? এই প্রশ্ন উঠছে এই কারণে যে, এর কোনোটিতেই নারীটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিংবা অমতে, বলপ্রয়োগে বা ভীতিপ্রদর্শন করে কিংবা ‘বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেছে’ এই মর্মে শঠতা করে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করা হয়নি। সুতরাং এখানে ‘প্রতারণা’র অস্তিত্ব থাকলেও, আমাদের বিদ্যমান আইনে ধর্ষণের যে সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে, তার আওতায় একে আনা সম্ভব নয়।
সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিমকোর্টে একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে, কোনো মেয়ে যদি কোনো ছেলের সঙ্গে পরিণয় থাকা অবস্থায় শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয় এবং তখন যদি সে এ বিষয়ে আপত্তি না দেয় তাহলে সম্পর্ক চুকিয়ে যাওয়ার পর বিগত দিনের ঘটনার জন্য ধর্ষণের কোনো অভিযোগ আনা যাবে না। এ ছাড়া বিচারপতি বিক্রমজিৎ সেন ও বিচারপতি এসকে সিংয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি বেঞ্চ মেয়েদের ব্যর্থ সম্পর্কের পরিণতিতে এবং বিয়ের প্রলোভনের ভিত্তিতে দায়ের করা ধর্ষণ মামলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিষয়টি ধর্ষণ হবে কি-না, সে বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন ‘বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের মতো নৈতিক স্খলনকে কি ধর্ষণ বলা যায়, যখন নারীটি খোলা চোখে পুরুষটির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন?’ আদালত তার সিদ্ধান্তে বিষয়টি দেখিয়েছেন এভাবে ‘এটি ভালোবাসা নয়, বোকামি’।
২০১৩ সালের ‘দীপক গুলাতি বনাম হরিয়ানা রাজ্য’ মামলায় বিচারপতি বিএস চৌহান ও বিচারপতি দীপক মিশ্র এ বিষয়ে আসামির পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন এবং মন্তব্যে বলেন, ‘যখন ছেলে-মেয়ের মধ্যে গভীর ভালোবাসা থাকে তখন তারা অনেক সময় একাধিকবার এবং পুনঃপুনঃ একে অন্যকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে; যার ফলে ওই প্রতিশ্রুতি তার গুরুত্ব হারায়। অর্থাৎ ছেলে কর্তৃক ওই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে মেয়ে যদি তার সর্বস্ব সজ্ঞানে ভয়ভীতি ছাড়া ওই ছেলেকে দেহ দান করে, সে ক্ষেত্রে পরে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর কোনো পক্ষের আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়; অর্থাৎ ধর্ষণের মামলা এখানে অচল।’
ভারতের রাজধানী দিল্লির একটি আদালত জানিয়েছে, বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কে জড়ানো অনৈতিক এবং প্রতিটি ধর্ম-আদর্শের পরিপন্থী। বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে দুজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে সংঘটিত প্রতিটি শারীরিক সম্পর্কই ‘ধর্ষণ’ বলে গণ্য হতে পারে না বলে ওই রায়ে বলা হয়। বিচারক বীরেন্দর বাট বলেন, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক, শিক্ষিত ও চাকরিজীবী নারী যদি বিয়ের প্রতিশ্রুতি পেয়ে পরিচিতজনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়ান তবে মনে করতে হবে তিনি তা নিজ থেকে ঝুঁকি নিয়েই কাজটি করছেন। তিনি বলেন, কোনো নারী যদি তার পুরুষ বন্ধু বা সহকর্মীর সঙ্গে ভবিষ্যতে বিয়ের প্রতিশ্রুতি পেয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন, সেক্ষেত্রে পরে ওই প্রতিশ্রুতি পালিত না হলে ধর্ষণের অভিযোগ আনতে পারবেন না, কারণ একে ‘ধর্ষণ’ বলে গণ্য করা যায় না। এ ধরনের প্রাকবিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের আগে অবশ্যই তার পরিণতি বা ফলাফল ভেবে রাখা উচিত। কারণ, তার সঙ্গী যে প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করবেন না এরকম কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। বিচারক আরো বলেন, যৌন সম্পর্কে সম্মতি দেয়ার ক্ষেত্রে নারীটি যে কেবল পুরুষটির বিয়ে করার প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করেছেন এবং এই প্রতিশ্রুতি না দেয়া হলে তিনি এই সম্পর্কে জড়াতেন না, এমন কোনো প্রমাণ আদালতের কাছে নেই। বরং এমন অনেক মেইল এবং চ্যাট হিস্ট্রি রয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে শারীরিক সম্পর্ক তৈরিতে নারীটির যথেষ্ট আগ্রহ ছিল এবং এই মর্মে তিনি পুরুষটিকে আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। এরকম পরিস্থিতিতে এই সম্পর্কের সুবিধা-অসুবিধার প্রতিটি দিক ভেবে নেয়া উচিত ছিল মেয়েটির। সব মিলিয়ে আদালতের কাছে মনে হয়েছে, কেবল প্রতারণামূলক প্রতিশ্রুতির কারণে নয়, বরং শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোর ব্যাপারে মেয়েটির ভালোবাসা এবং আগ্রহও কাজ করেছে।
দিল্লির নিম্ন আদালতের এই রায় অবশ্য দিল্লি হাইকোর্ট থেকে ‘লিঙ্গ পক্ষপাতদুষ্ট’ মর্মে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। এ ধরনের ঘটনাকে ‘ধর্ষণ’ বলা হবে কি-না, সেদিকে হাইকোর্টের বিচারপতিরা কোনো মন্তব্য করেননি। তারা বলেছেন, যে কোনো রকমের জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের। সুতরাং আদালত কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে এ কথা বলতে পারে না যে, তুমি যেহেতু নিজ ঝুঁকিতে এই জীবন গ্রহণ করেছ, সুতরাং তোমার কান্না শুনতে আমরা রাজি নই। নারীর প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে এরকম রায় দেয়া হলে পুলিশ পরবর্তীতে এ ধরনের মামলা হালকাভাবে নেবে বলে হাইকোর্ট মত প্রকাশ করে।
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলায় (যা ৫৭ ডিএলআরের ৫৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে) বলেছেন, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম কোনরূপ বাঁধা না দেয় অথবা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয় তাহলে ধর্ষণ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে।
মোটকথা, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ যখন জেনে-বুঝে কোনো শারীরিক সম্পর্কে জড়াবেন তখন পরবর্তীতে সেই সম্পর্ককে ‘ধর্ষণ’ হিসেবে আদালতের কাছে প্রমাণ করা কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের দায়ে প্রতারণার মামলা চলতে পারে। তবে ভিকটিম যদি ১৪ বছরের কম বয়সী হয়, তাহলে সেটিকে ‘ধর্ষণ’ বলা হবে। কারণ এই বয়সী মেয়ে সম্মতি দেয়ার মতো সক্ষমতা রাখে না বলে আইন মনে করে।
কেবল প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়ানোর আগে নারীদের অত্যন্ত সতর্ক ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। পরবর্তীতে প্রতিশ্রুতি যখন পালিত হচ্ছে না, তখন নারীটির জীবনে নেমে আসছে ভয়াবহ বিপর্যয়। কিন্তু পুরুষটি পার পেয়ে যাচ্ছে সামান্য আইনি চাপ কিংবা স্বল্প পরিমাণের জেল-জরিমানা দিয়ে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করার পর প্রতারণা করা হলে তার সাজা আরো কঠোর করা যায় কি-না, সে ব্যাপারে আইনবিদরা ভাবতে পারেন। কেননা, বিদ্যমান আইনে প্রতারণার সাজা অপ্রতুল। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করার পর যে প্রতারণা করা হয়, তার জন্য আলাদা আইন ও সাজার ব্যবস্থা করা যায় কি-না আইনবিদরা ভেবে দেখবেন কি?
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮